সালটা ঠিক মনে করতে পারছি না, তবে গত শতাব্দীর নয়ের দশকের গোড়ার দিকে বাশারকে প্রথম দেখি তপংকরের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে। তপংকর আমার আত্মীয় এবং বন্ধু, বাংলাদেশের বরিশালে থাকে। ওরা আমার মেজদার ঘরে বসে গল্প-গুজবে মশগুল। আমারও ডাক এলো সেই আড্ডায় যোগ দেওয়ার।
বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে আমার জন্মভিটে। তাই ওপার বাংলার মানুষ দেখলেই মনে পড়ে যায় শৈশবে ছেড়ে আশা জন্মভূমির কথা, তাদের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের গভীর আগ্রহ হয় আমার। তপংকরের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তার কয়েক বছর আগে থেকেই। ও তখন বেসরকারি কলেজের একজন অধ্যাপক। তপংকরই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল একজন ২৭-২৮ বছর বয়সি শীর্ণকায়-শ্যামবর্ণ যুবকের সঙ্গে। চোখ দুটো উজ্জ্বল এবং সপ্রতিভ। চোখের তারা দুটো যেন সবসময় কিছু একটা খুঁজছে। তপংকর বলল, শ্যামলদা, ওর নাম সিকদার আবুল বাশার। ও ঢাকার একজন প্রকাশক। ওর প্রকাশন সংস্থার নাম ‘গতিধারা’। যান্ত্রিকভাবে নমস্কার বিনিময় করলাম বটে কিন্তু মনের মধ্যে তখন খেলে চলেছে এক দুষ্ট ভাবনা। মনে মনে ভাবছি বাংলাদেশের সবাই নাকি ‘এককালে জমিদার ছিল’। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পরে এখন কি সবাই ‘প্রকাশক-সাহিত্যিক-মুক্তিযোদ্ধা হইছে’। এই নাকি প্রকাশক! আমাদের দেশের প্রকাশকদের এক এক জনকে তো ভিন্ন গ্রহের মানুষ বলে মনে হয়। কোথায় আনন্দবাজার, দেশ, যুগান্তর, বসুমতী! বুঝতে পারলাম, ছেলেটি আমাকে মাপছে।
আসলে আমি নিজেকে যতই ভদ্র, বিনয়ী ভাবি না কেন, ভেতরে ভেতরে এক ধরনের চাপা উন্নাসিকতা আমার মধ্যেও ছিল। তখন আমি কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করি। এটা সেটা লিখি। বিভিন্ন পাড়ার থিয়েটার নির্দেশনার কাজ করি। কিন্তু একটা কথা নিজেকে বলতেই হচ্ছে, এই উন্নাসিকতা কখনোই মানুষের প্রতি আমার আন্তরিক ভালোবাসার অন্তরায় হয়ে ওঠেনি। সেই আন্তরিকতার জন্যেই হয়তো- সেদিনের কথোপকথন ও আলাপচারিতার পর ঐ প্রকাশক যুবকটি বুঝেছিল, এই মানুষটি আর যাই হোক, এর সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায়। এরপর যতবারই বাশার কলকাতা এসেছে, একা বা দোকা ওর ঠিকানা হয়েছে আমার পলেস্তারা খসা ঘরটি। কলকাতায় পদার্পণ করেই ও আমাকে ফোন করত, ‘শ্যামলদা, আমি বাশার, আমি কলকাতা আসছি।’ একবার অফিসে ফোন এলো, শ্যামলদা আমি বাশার, কলকাতা আসছি আমার এক বন্ধু ও তার ভগ্নিপতিকে নিয়ে। বন্ধুর ভগ্নিপতির একটু মানসিক সমস্যা আছে, ডাক্তার দেখাতে হবে। বললাম, ঠিক আছে, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। মনে মনে ভাবলাম, বাশার যদি তার এতো কর্ম-ব্যস্ততার মধ্যেও বন্ধুর ভগ্নিপতিকে ডাক্তার দেখানোর জন্য এক দেশ থেকে আর এক দেশে পাড়ি দিতে পারে, আমি এখানে থেকে এটুকু পারবো না! ডাক্তার দেখানো হলো, রোগি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে গেল। আমার স্মৃতিতে লেগে রইল আমার দেশের মানুষের বন্ধুত্ব, ভালোবাসা।
বাশারের সেই বন্ধু সেলিম সাহেব বাংলাদেশের প্রকাশন সংস্থা ‘কাকলী প্রকাশনী’র কর্ণধার। আর একবার গবেষক ড. তপন বাগচীকে নিয়ে এসেছিল। একবার ওর সঙ্গে এসেছিলেন রাহুল আমিন বাবুল, তিনি একজন স্বভাবকবি। তিনিও আমার স্মৃতিতে অমলিন। এই রকম অনেকেই এসেছেন আমার বাড়িতে।
একজন সুপ্রতিষ্ঠিত প্রকাশক, সাহিত্যিক, গবেষক শিল্পী সিকদার আবুল বাশার, সেদিনের সেই ছিপছিপে যুবক, এখন কলকাতায় পা রাখলে ওই একই রকমভাবে আর ফোন করে বলবে না, ‘শ্যামলদা, আমি বাশার, আমি কলকাতা আসছি।’ ভাবতেই আমার বুকের ভেতরটা ছলাৎ করে ওঠে। আবার যদি দেখা হতো ধানসিঁড়ি নদীপাড়ের প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে!
সিকদার আবুল বাশার, যিনি বাংলাদেশের বিদগ্ধ মহলে অতি পরিচিত, পরপর তিন বছর শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদশিল্পীর জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন কৃতী মানুষ, প্রকাশনার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের নায়ক। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন এদেশের একজন সাধারণ মানুষকে ভোলেননি। আমার চেতনে-অবচেতনে জন্মভূমির যে ছবি আমার মানসচক্ষে প্রতিভাত, তা ছিল কেবলি কল্পনাপ্রসূত। জন্মভূমির প্রতি স্বাভাবিক অভিকর্ষহেতু- অন্তত একবারের জন্য হলেও জন্মভিটেকে স্পর্শ করার এক অসহনীয় তাড়না অনুভব করতাম। অন্তত একবার পূর্বপুরুষের আবাসভূমির সামনে দাঁড়িয়ে প্রণত হওয়ার। সেই প্রায় অসম্ভব ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়েছিল বন্ধু বাশারের উদ্যোগে। আমাকে দিয়ে এক রকম জোর করে পাসপোর্ট করাল। নিজে এদেশে এসে আমাকে নিয়ে গিয়ে ভিসার ব্যবস্থা করলো, তারপর আমাকে নিয়ে রওনা হলো বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীর মনে সে যে কী এক রোমাঞ্চ অনুভব করলাম, তা ভাষায় অনুবাদ করা সম্ভব নয়।
আমরা বরিশালে যখন পৌঁছলাম তখন রাত দেরটা। সেখান থেকে রিক্সায় করে গিয়ে উঠলাম তপংকরের বাড়ি। নিঃঝুম রাত। সব ঘুমে অচেতন। বাড়ির সামনেই একটা ঘাট বাঁধানো পুকুর। আমি বাশারকে বললাম, এখন ডাকাডাকির দরকার নেই, আমরা পুকুরপাড়ে বসে গল্পগুজব করে রাতটা কাটিয়ে সকালে ডাকবো। তাই হলো। বাশারের মৃত্যুতে সেই রাতের স্মৃতি এখন আমাকে তাড়া করে বেরাচ্ছে।
মনে আছে, শৈশবের সেইসব স্মৃতি খুঁজেফিরে যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে স্টিমারে উঠলাম, পাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখি শুভংকর দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকেও আমার দৃষ্টি এড়াল না, দেখলাম ওর চোখ দুটো ছলছল করছে। ভোরবেলা সদরঘাট থেকে সোজা বাশারের বাড়ি। এই স্বদেশ পরিক্রমার প্রতিটি মুহূর্তে বাশার ছিল আমার ভ্রমণসঙ্গী। বারবার চেতনে-অবচেতনে উচ্চারণ করেছি- ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে।’ সেটাও শুধু বাশারের জন্য।
সৃজনশীল, ব্যতিক্রমী উৎকৃষ্ট সৃষ্টির নমুনা রেখে যেতে পারেন, এই রকম যে দু’একজন মানুষের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, তার মধ্যে সিকদার আবুল বাশার শ্রেষ্ঠতম। যে নিষ্ঠা, অনুসন্ধিৎসা, পর্যবেক্ষণ ও পরিশ্রমের নমুনা আমি ওর মধ্যে লক্ষ্য করেছি, তার আর কোনো নজির আমার কাছে নেই। শূন্য থেকে শুরু করে আজ যে কৃতিত্ব ও রেখে গেলো, তার সবটাই ওর নিজস্ব অর্জন।