ছিলেন মসজিদের ইমাম। মুসুল্লিদের নামাজ পড়াতেন। কুরআন-কেতাব পড়তেন। আবার বাউল গান গেয়ে মাতিয়ে তুলতেন ভক্তদের আসর। ইমামতি করার কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে তিনি ছিলেন ‘উকিল মুন্সি। আবার বাউল গান করার কারণে ভক্তদের কাছে ছিলেন ‘উকিল বাউল’। আর একই সঙ্গে দু’দুটো পেশার কারণে দিনে দিনে সবার কাছে ওঠেছিলেন ‘বাউল উকিল মুন্সি’। হ্যাঁ, এমনই এক ব্যতিক্রম চরিত্রের মানুষ ছিলেন বিরহী বাউল উকিল মুন্সি।
উকিল মুন্সির আসল নাম আব্দুল হক আকন্দ। উকিল তার ডাক নাম। জন্ম ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ জুন নেত্রকোনার হাওরদ্বীপ খ্যাত খালিয়াজুরী উপজেলার নূরপুর-বোয়ালী গ্রামে। শৈশবেই তিনি বাংলায় বাল্যশিক্ষা পড়ার পাশাপাশি আরবি ও কুরআন শিক্ষা গ্রহণ করেন। উকিলের বয়স যখন মাত্র দশ, তখন কলেরায় তার বাবা গোলাম রসুল আকন্দ মারা যান। এর কিছুদিন পর তার মা উকিলেন্নেছা মদন উপজেলার হাসনপুর গ্রামের এক ব্যক্তিকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। উকিল আর তাঁর ছোট ভাইও চলে যান হাসনপুরে। কিন্তু সৎ বাবার সংসারে বেশিদিন থাকা হয়নি তাদের। এক পর্যায়ে আশ্রয় হয় ফুফুর কাছে। কিছুদিন ফুফুর বাড়িতে আবার কিছুদিন নিজ গ্রামে, এভাবে দিন কাটতে থাকে পিতৃ-মাতৃছায়াহীন দুভাইয়ের।
এখানে-সেখানে ঘর-বন্ধনহীন বসবাসের কারণে উদাসিপনা পেয়ে বসে উকিলকে। ওই সময়ে নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে ঘাটুগানের ব্যাপক কদর ছিল। ১৭-১৮ বছর বয়সে তিনি ঘাটুগানের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। আর ঘাটু গান করতে করতেই একসময় রপ্ত করেন বাউল গান। বিশ শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝি তিনি বাউল হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। একদিন মোহনগঞ্জের জালালপুর গ্রামে চাচা কাজী আলিম উদ্দিনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কৃষক লবু হোসেনের মেয়ে হামিদা আক্তার খাতুনের (লাবুশের মা) প্রেমে পড়ে যান। তাকে নিয়ে রচনা করেন গান: ‘ধনু নদীর পশ্চিম পাড়ে/ সোনার জালালপুর/ সেইখানেতে বসত করে/ উকিলের মনচোর…’। তাদের প্রেমের কথা জানাজানি হলে চাচা আলিম উদ্দিন বাধা হয়ে দাঁড়ান। আভিজাত্য বিবেচনায় সাধারণ কৃষক লবু হোসেনের মেয়েকে বিয়ে করাতে অমত প্রকাশ করেন। এমন সময়ে আরও একটি দুর্ঘটনার মুখে পড়েন উকিল। অসুস্থতায় মারা যান তার ছোট ভাই আব্দুল মজিদ। একদিকে প্রেয়সীর সঙ্গে বিরহ, অন্যদিকে ভাইয়ের মৃত্যুর শোকে কিছুটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে যান তিনি। ফলে আবার বাড়ি ছাড়েন। এ পর্যায়ে (১৯১৫) মোহনগঞ্জের বড়ান্তর গ্রামের মসজিদে ইমামতি ও আরবি পড়ানোর কাজে যোগ দেন।
জালালপুরের কাছাকাছি বড়ান্তরে গিয়ে আবারও যোগাযোগ ঘটে হামিদার সঙ্গে। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে আত্মীয়-স্বজনের অগোচরে তাকে বিয়ে করেন তিনি। এরপর জালালপুরেই ঘর বাঁধেন। দুবছরের মাথায় আব্দুস সাত্তার নামে প্রথম ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। সাত্তারের জন্মের পর উকিল মুন্সি মদনের কুলিয়াটি মসজিদে ইমাম নিযুক্ত হন। সেখানে অনেক গজল রচনা ও সুর করেন। কুলিয়াটিতে থাকাকালেই হবিগঞ্জের রিচি গ্রামের পীর মোজাফফর আহম্মদের (র.) শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তিনি। তখন পীরের নির্দেশে অন্য সব বাদ্য পরিত্যাগ করে শুধু একতারা ও চটিয়া বাজিয়ে গান শুরু করেন। কুলিয়াটির পর তিনি মোহনগঞ্জের পালগাঁও মসজিদে চলে যান। ইমামতির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন এলাকার পীরদের আস্তানায় যাতায়াত করতেন। একদিন লেডিরকান্দা পাগলবাড়িতে গান গাইতে গিয়ে পরিচয় হয় বাউলসাধক রশিদ উদ্দিন, জালাল খাঁ ও উপেন্দ্র সরকারের সঙ্গে। তারা উকিলকে মালজোড়া বাউল গানের প্রতি উৎসাহিত করেন। তাদের সংষ্পর্শে উকিল মালজোড়া বাউলগানের শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পালগাঁও ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তিনি চানগাঁও, শ্যামপুর ও নূরপুর-বোয়ালী গ্রামের মসজিদে ইমামতি করেছেন। শেষ জীবনে ছিলেন মোহনগঞ্জের জৈনপুর মসজিদের ইমাম। এক পর্যায়ে তিনি জালালপুর ছেড়ে জৈনপুর গ্রামে সুরমা নদীর কূল ঘেঁষে বাড়ি করেন এবং থিতু হন।
সাত্তারের পর পুলিশ মিয়া নামে আরও এক ছেলে এবং সন্তোষের মা ও রাবেয়া খাতুন নামে দুই মেয়ের জন্ম হয় তার। সাত্তার এন্ট্রাস পাশ করে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। পাশাপাশি বাউল গান রপ্ত করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। চল্লিশের দশকে পিতা-পুত্র একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বহু মালজোড়ার আসরে গান করেছেন। ১৯৭৮ সালে উকিলের জীবনে বড় বিপর্যয় নেমে আসে। ওই বছরের প্রথম দিকে তার স্ত্রী হামিদা খাতুন মারা যান। স্ত্রীর কয়েক মাস পর ৬ আগস্ট (১৯৭৮) অকালে মারা যান তাঁর ছেলে বাউলকবি আব্দুস সাত্তার। স্ত্রী-পুত্রের মৃত্যুর পর তাঁর চোখের জল আর থামেনি। ঘরে বসে তখন একা একা গান করতেন, ‘আমার শ্যাম সুখ পাখি গো/ ধইরা দে ধইরা দে…’। প্রিয়জন হারানোর শোকে মুহ্যমান উকিল মুন্সিও ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
লালন ধারার বাউলদের জীবন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাঁদের অনেকে প্রচলিত ধর্মমতের বাইরে ছিলেন। অর্থাৎ তাদের নিজস্ব ঘরানার একটা ধর্মমত ছিল। এর নাম ‘বাউল ধর্ম’ বা ‘বাউল মতবাদ’। আবার তাদের অনেকে ছিলেন গৃহত্যাগী বা সন্ন্যাসী। কিন্তু নেত্রকোনা অঞ্চলের বাউলরা ছিলেন ব্যতিক্রম। তারা একই সঙ্গে বাউল গান করেছেন এবং আবার কেউ কেউ ধর্ম চর্চাও করেছেন। গৃহত্যাগ বা সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেননি। উপরন্তু স্বাভাবিক রীতিতে সংসার করেছেন তারা। উকিল মুন্সিও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি সম্পূর্ণ শরিয়তপন্থী, ভক্তদের মতে ‘আল্লাহওয়ালা মানুষ’ ছিলেন। মালজোড়া বাউলগানে শরিয়ত ও মারেফত সংক্রান্ত বিতর্কে তিনি সবসময় শরিয়তের পক্ষে অবস্থান নিতেন এবং শরিয়ত সংক্রান্ত জ্ঞানে দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করতেন।
আধ্যাত্মিক গানে অগাধ পাণ্ডিত্য থাকলেও বিচ্ছেদ গানে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বিচ্ছেদ গানে পারদর্শিতার কারণেই তার আরেক পরিচিতি ‘বিরহী বাউল’। উকিল নিজেও সারাজীবন ‘বিচ্ছেদের অনলে পুড়ে অঙ্গার’ হয়েছেন। শৈশবে বাবাকে হারান। মাকে হারান মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের কারণে। কৈশোরে হারান ছোট ভাইকে। এরপর প্রিয়তম প্রেমিকাকে কাছে পেতে গিয়েও নানা বাধার বেদনায় নীল হতে হয়েছে তাঁকে। শেষ জীবনে কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে প্রিয় পুত্রের লাশ। চোখের সামনে দেখতে হয়েছে প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যু। এসব ঘটনাপ্রবাহ উকিলকে বিরহে ভাসিয়ে দেয়। আর বিরহে ভাসতে ভাসতেই তিনি হয়ে ওঠেন ‘বিরহী বাউল’।
শোনা যায়, উকিল মুন্সির মতো বিচ্ছেদ গানের সুর ও কণ্ঠ এ অঞ্চলে দ্বিতীয় কারো ছিল না। ধর্মশাস্ত্র নিয়ে গান গাইতে গেলেও দর্শকদের অনুরোধে তাঁকে বিরহের গান গাইতে গয়েছে। আসরে তিনি নিজে যেমন কেঁদেছেন, তেমনি কাঁদিয়েছেন হাজারও শ্রোতাদের। দুটো গানের উদাহরণ দেয়া যাক, ‘বন্ধু আমার নিঃদুনিয়ার ধনরে/তোরে দেখলে জুড়ায় জীবন আমার/না দেখলে মরণরে…’ অথবা ‘এমন শুভদিন আমার কোনদিন হবে/প্রাণনাথ আসিয়া আমার দুঃখ দেখিয়া/নয়নের জল বন্দে-নি মুছিয়া নিবে…।’ এছাড়া উকিলের বিখ্যাত ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ গানটি হয়তো অনেকেরই শোনা। এভাবেই সহজ-সরল কথায় আর বিরহচাপা সুরে মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা কষ্টকে টেনে বেড় করতেন উকিল মুন্সি।
উকিলের প্রায় সারাজীবন কেটেছে হাওরের গহীন গ্রামে। তাই হাওরের প্রকৃতিকে অপরূপভাবে বর্ণনা করেছেন তিনি। গানের কথা আর সুরে মনের গহীনের বিরহকে যেন প্রকৃতির সঙ্গে একাকার করে দিয়েছেন। যেমন- ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে/ পূবালী বাতাসে/ বাদাম দেইখ্যা চাইয়্যা থাকি/ আমার নি কেউ আসেরে’ অথবা, ‘ভাইটাল তরী কে যাও বাইয়া রে/ ও মাঝি ঘাটে নাও ভিড়াও/ মুই অভাগী চিরদুঃখী খবর লইয়া যাওরে’ এমন আরও অসংখ্য ভাটিয়ালী এবং বিচ্ছেদী গান আছে তার। উকিলের পরিবার, স্থানীয় সংগ্রাহক ও বাউলদের মতে, তার গান ও গজলের সংখ্যা সহস্রাধিক। প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ এবং ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি’ গান দুটি যুক্ত করে উকিল মুন্সিকে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এর বাইরে উকিলের আর মাত্র ১০-১২টি গান এ অঞ্চলের বাউল-শিল্পীরা পরিবেশন করে থাকেন। বাকি গানগুলো এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে। কারণ, তার গানের কোন বই নেই।
কবি মাহবুব কবির উকিল মুন্সির ২শ ১টি গান সংগ্রহ করে ‘উকিল মুন্সির গান’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন। এ যাবতকালে এটিই তার গানের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ। বাদবাকি গানগুলোও সংগ্রহ করা দরকার। চর্চার অভাবে তাঁর অনেক গানের সুরও আজ হারাবার পথে। তার শিষ্য- প্রশিষ্যদের কাছ থেকে এসব গানের সুর রেকর্ড করে সংরক্ষণ করা আজ জরুরী। তা না হলে উকিলের অনেক গান এবং গানের সুর চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে। একই সঙ্গে হারিয়ে যাবে বিচ্ছেদ ও ভাটিয়ালী গানের বিশাল এক ভাণ্ডার।